পথশিশুদের আশ্রয়স্থল ‘জ্যোতি’

মুন্নী, সুখী, মিম, রায়হান, আকাশ, লিটন, রাব্বি, শরিফুলদের দুচোখ ভরা স্বপ্ন। ওরা পথশিশু। তাদের কারো মা আছে তো বাবা নেই, কারো মা-বাবা দুজন থেকেও নেই। জন্মের পর রেলস্টেশন, বাস বা লঞ্চ টার্মিনাল অথবা জনবহুল রাস্তার পাশেই ঠাঁই হয়েছে ওদের।

রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠা এ রকম ৪০ জন পথশিশুর ভালোবাসার আশ্রয়স্থল এখন খুলনা নগরীর ১১৬/৯ সি, মজিদ সরণির পথশিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র বেসরকারি সংস্থা ‘জ্যোতি’।

অন্য শিশুরা যখন পরিবারের আদর পেয়ে বই কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে, ঠিক তখন পথশিশুরা রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে হয়তো পরিত্যক্ত পানির বোতল কিংবা অন্যান্য আবর্জনা খোঁজে। তাদের চিন্তা থাকে কেবল দুবেলা পেটপুরে খাওয়া। কখনো কখনো তাদের কেউ হয়ে যায় মাদকাসক্ত, কেউ ছিঁচকে চোর অথবা ছিনতাইকারী।

এই অন্ধকার পথ থেকে তাদের তুলে এনে সুন্দর জীবন গড়তে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘জ্যোতি’।

১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৫২ পথশিশুকে নিয়ে খুলনা মহানগরীর ১১৬/৯ সি, মজিদ সরণিতে পথশিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে ‘জ্যোতি’। ওই পথশিশুদের খুলনা নগরীর রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল ও রাস্তার পাশের বিভিন্ন ঝুপড়ি থেকে নিয়ে আসেন একজন জেভেরিয়ান ফাদার ইতালীয় নাগরিক রিকার্ডো তুবানেল্লি, যিনি জ্যোতির প্রতিষ্ঠাতা।

বর্তমানে এই আশ্রয়কেন্দ্রে ৪০টি পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জন ছেলে এবং বাকি ২২ জন মেয়ে শিশু। প্রতি মাসে এই পথশিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠানটির খাওয়া খরচ হয় গড়ে ৯০ হাজার টাকা। এ ছাড়াও আছে শিক্ষা ও পোশাকসহ অন্যান্য খরচ। যা দিয়ে থাকেন সমাজের বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের শিশুদের দেখভালের জন্য তিন জন ব্যক্তি নিয়োজিত রয়েছেন।

সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনের উদ্দেশে জ্যোতির গেট পেরোতেই দৌড়ে এগিয়ে আসে চার বছরের ছোট্ট শিশু রায়হান।

এখানে কতদিন এসেছো, জিজ্ঞেস করতেই বলে ওঠে, ‘পাঁচ নম্বর ঘাট থেইকা ছয় মাস হইছে আইছি, এখনো স্কুলি যাইনি।’ বাবা-মার কথা জানতে চাইলেই মুখটা মলিন হয়ে যায় তার।

জানায়, বাবার নাম রুবেল, মা হেনা। বাবা-মা খোঁজ নেয় না তার, তবে নানি মাঝেমধ্যে খোঁজ নিয়ে যায়। লেখাপড়া শিখে সে চাকরি করতে চায়।

এখানে থাকা সবচেয়ে বেশি বয়সি মেয়ে মুন্নী। তার বয়স ১৭। মাত্র আট বছর বয়সে সে এখানে আসে। তারা পাঁচ ভাইবোন। এর মধ্যে তিন ভাইবোনই এখানে থাকে। সে এবার গাজী মিজানুর রহমান স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। তার ছোট বোন সুখীও (১৬) একই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর ছোট ভাই রিফাত (১২) ওই স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে।

শিশুরা জানায়, লঞ্চ টার্মিনাল বা রেলস্টেশনে তারা যখন থাকত তখন তাদের দুবেলা খাবারও জুটত না। এই আশ্রয়কেন্দ্রে এসে তারা অন্তত তিন বেলা খেতে পারছে।

তারা জানায়, সপ্তাহের প্রতি শনিবার ভাতের সঙ্গে নিরামিষ, রোববার নিরামিষের সঙ্গে ডিম, সোমবার দুধ, বাদাম, খেজুর, কিশমিশ মিশ্রিত পুষ্টিকর খাবার, মঙ্গলবার মাছ, বুধবার ডিম, বৃহস্পতিবার নিরামিষ ও শুক্রবার মুরগির মাংস খেতে দেওয়া হয়। এই খাবারই তাদের কাছে অনেক কিছু।

পথশিশুদের দেখভাল করা পিটার সরদার জানান, প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকেই তিনি এখানে কর্মরত। সঙ্গে তার স্ত্রী লিপি সরদার ও সাইফুল ইসলাম নামে আরো একজন দায়িত্ব পালন করছেন। শিশুদের শুধু খাওয়া-দাওয়া নয়, পড়াশোনার বিষয়টিও তারা দেখভাল করেন। যেসব শিশু উচ্চ শ্রেণিতে পড়ে, তাদের জন্য প্রাইভেট শিক্ষকের ব্যবস্থাও রয়েছে।

জ্যোতির নির্বাহী পরিচালক মোহসীনা রুনা বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি ১০ বছর ধরে আছেন। গত ২০২১ সালের ৭ মে জ্যোতির প্রতিষ্ঠাতা রিকার্ডো তুবানেল্লি হঠাৎ করেই স্ট্রোকে মারা যান। এর পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি কঠিন সময় পার করছে। তিনি প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন খরচ নিয়ে খুবই চিন্তিত।

‘শিশুরা যেন কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হয় তার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। করোনার আবির্ভাবের পর থেকে আমরা আর্থিক সংকটে আছি। কারণ যে মানুষদের আর্থিক সহায়তায় এ প্রতিষ্ঠান চলছে তাদের অনেকেই সমস্যায় আছেন। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এই আর্থিক সংকট উত্তরণের। এই শিশুদের প্রতি সবার ভালোবাসা প্রত্যাশা করি।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *